রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ—এই তিন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিতে বর্তমানে গভীর সংকট তৈরি করেছে সার বিতরণের একটি সংঘবদ্ধ কালোবাজার সিন্ডিকেট। সরকারি হিসেবে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকিপ্রাপ্ত সারের বরাদ্দ থাকলেও, তা নির্ধারিত মূল্যে কৃষকের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। স্থানীয় কৃষক ও উৎপাদকদের অভিযোগ, ডিলারদের গুদাম থেকে শুরু করে বিপণন চেইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সারের বড় অংশ সরাসরি কালোবাজারে চলে যাচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
ভর্তুকিপ্রাপ্ত সারে চরম মূল্য কারসাজি
কৃষকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে সার পাওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫০ কেজির ডিএপি সারের সরকারি মূল্য ১,০৫০ টাকা থাকলেও, বাজারে একই সার কৃষককে কিনতে হচ্ছে ১,৪৫০ টাকা থেকে ১,৭০০ টাকা পর্যন্ত দামে। অর্থাৎ, প্রতিটি সারের বস্তায় কৃষককে সরকারি মূল্যের চেয়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি গুনতে হচ্ছে।
-
সংকটের প্রভাব: এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু কৃষকের পকেট কাটছে না, আলু ও বোরো ধানের মতো প্রধান ফসলের আবাদে মারাত্মক বিলম্ব ঘটাচ্ছে। সারের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় কৃষকরা সঠিক সময়ে সার প্রয়োগ করতে পারছেন না, যা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে।
'স্টক শেষ'—অথচ কালোবাজারে পাওয়া যায় সার
কৃষক সংগঠন ও স্থানীয় নেতারা সরাসরি ডিলার এবং গুদাম কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাদের অভিযোগ:
-
গুদাম থেকে সরাসরিমুক্তি: সরকারি বরাদ্দের সার ডিলারদের কাছ থেকে কৃষকের কাছে না পৌঁছে অনেক সময় গুদাম থেকেই সরাসরি কালোবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।
-
মিথ্যা অজুহাত: কৃষকরা বলছেন, "সরকারি কোটা থাকা সত্ত্বেও ডিলার বা খুচরা দোকানে গেলে 'স্টক শেষ' বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ কিছু দূরেই কালোবাজারে একই সার চড়া দামে পাওয়া যায়।"
-
তানোর-গোদাগাড়ীর চিত্র: তানোর ও গোদাগাড়ীর কৃষকরা বিশেষভাবে জানিয়েছেন, সারের বরাদ্দ সত্ত্বেও ডিলারের গুদামে কৃত্রিম গড়িমসি করা হচ্ছে বা অবৈধভাবে সার সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে, ফলে কৃষককে অতিরিক্ত খরচে কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
মনিটরিং কমিটির নিষ্ক্রিয়তা ও প্রশাসনিক ঘাটতি
সরকারি বরাদ্দ বাজারে পৌঁছানোর জন্য নিয়মিতভাবে সার মনিটরিং কমিটি গঠন করা হলেও, বাস্তবে এর কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, কমিটিগুলো গতানুগতিকভাবে কিছু অভিযান চালিয়ে সামান্য সার জব্দ করে জরিমানা করেই দায় সারছে। এর ফলে মূল সমস্যা সমাধান হচ্ছে না এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কৃষক বলেন, "উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ শুধু বলছেন, 'ডিলারের দোকানে স্টক চেক করা হচ্ছে এবং অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।' কিন্তু স্টক চেক করা হলে কি কার্যকরভাবে সার পৌঁছায়? কৃষিকেই তার উৎপাদনের সময় ও খরচ সামলাতে হচ্ছে।"—কৃষকরা প্রশ্ন তোলেন।
উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধি ও ঝুঁকির মুখে কৃষি অর্থনীতি
কৃষি বিশ্লেষকদের মতে, সারের কৃত্রিম সংকট ও কালোবাজার সিন্ডিকেট বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
এক দূরদর্শী কৃষি বিশ্লেষক বলেন, “সরকারি বরাদ্দ থাকলে সঠিক মনিটরিং ও সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেট কৃষকের লাভের মার্জিন কমিয়ে দিচ্ছে এবং উৎপাদনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই চোরাই বাজারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কৃষিখাতের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।”
কৃষকরা দ্রুত প্রশাসনিক পর্যায়ে কঠোর নজরদারি, সার মনিটরিং কমিটিকে আরও ক্ষমতাশীল করা এবং কালোবাজার সিন্ডিকেট ভাঙার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায়, এই চলমান সংকট বরেন্দ্র অঞ্চলের কোটি টাকার ফসলের উৎপাদনে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
ইব্রাহীম হোসেন সম্রাট